প্রহ্লাদ ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে স্বভাবের। পড়াশোনায় তেমন ভালো না হলেও দুষ্টুমি তে তার জুড়ি মেলা ভার। ডুব দিয়ে সাঁতার কেটে পুকুর পার করা হোক কিংবা গাছে উঠে সরস্বতী পুজোর আগে কুল পাড়া সবটা ছিল তার মস্তিষ্কের ধূসর বস্তুতে। স্কুলের বিভিন্ন খেলা যেমন দৌড়,লং জাম্প,হাই জাম্প প্রভৃতি বিভাগ সে সর্বদাই প্রথম পুরষ্কার নিজের দখলে রাখতে। স্কুলের গন্ডি পার করে সে ঠিক করলো সেনা বাহিনী তে যোগ দেবে। তার এক পিসমশাই ছিলেন মিলিটারি তে। একবার শত্রু পক্ষের সাথে যুদ্ধে তিনি শহিদ হলেন। পালিয়ে কোনক্রমে বর্ডার ক্রস করতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতেন কিন্তু পাথুরে জমির উপর ছুটে যেতে যেতে ছিঁড়ে যায় জুতো। পিছন থেকে তীব্র বেগে আসা বুলেট ঝাঁজরা করে দেয় শরীর। বিরোধী দল গুলি সেনাবাহিনীর মেটেরিয়াল নিয়ে তাই তোলে সংসদে প্রশ্ন।
প্রহ্লাদের পিসমশাই নেপাল পুরকায়স্থ ছিলো তার আদর্শ। সে গ্রামের মাঠে রোজ ছুট প্র্যাকটিস করলেও কিছুতেই আসল জায়গায় গিয়ে তার দৌড় শেষ করতে পারত না। দিন দিন বয়স এইভাবে বাড়তে থাকায় একসময় সে রাতেও ছুট প্রাকটিস করা শুরু করলো।
গ্ৰামের অলোক সেন থাকতেন কলকাতার মেসে। পেশায় ছিলেন সরকারি এক দপ্তরের কেরানি। সপ্তাহের শেষে ফিরতেন তাঁর গ্রাম মকন্দ পুরে। শেষ ট্রেনে নেমে ভ্যানে চেপে বাড়ি ফেরেন। সেদিন একই রকম ভাবে শুক্রবার রাতে ফিরছিলেন অলোক সেন। ভ্যানে যাত্রী বলতে তিনি ছিলেন একাই। হঠাৎ প্রকৃতির ডাক আসায় তিনি ভ্যান থামিয়ে পেয়ারা বাগানে ঢোকেন শরীরের উত্তাপ কমানোর উদ্দেশ্যে। তখনই দেখেন প্রহ্লাদ খুব ধীর গতিতে ছুটছে তার চারপাশে পাক খাচ্ছে জ্বলন্ত দুটো পা। এই দৃশ্য দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ ফিরে আসেন এবং ভ্যানে চেপে বাড়ি ফেরেন। প্রহ্লাদের দৌড় তিনি আগেই দেখেছেন যখন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অলোক পারস শিক্ষক ছিলেন। তাই প্রহ্লাদের এই অস্বাভাবিক আস্তে দৌড়ানো আর ওই জ্বলন্ত দুটো পা চোখের পাতা এক করতে দিলো না আলোকের। পরেরদিন তিনি সকাল হতেই সব কথা গিয়ে জানালো প্রহ্লাদের বাবা শেখর ঘোষ কে। সব শুনে তিনি উড়িয়ে দিলেন এবং তাঁর একমাত্র সন্তানের বিরুদ্ধে যে চক্রান্ত চলছে সেটা সাফ জানিয়ে দিলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা অলোক সোজা চলে গেল ভ্যান চালক ভেটকোলের বাড়ি। ভেটকোলের ভ্যান একমাত্র শেষ ট্রেনের প্যাসেজ্ঞার নিয়ে ফিরত তাই সে যে এতদিনে কিছু দেখেনি এটা হতেই পারে না বলে বিশ্বাস ছিল অলোকের। তাই যখন সে বাংলার একটা বোতল দিলো ভেটকোলের হাতে এক ঢোক গিলে সে জানালো অলোক সেদিন রাতে ভুল কিছুই দেখেনি।শেষ ট্রেনে যে গুটি কতক প্যাসেজ্ঞার ফেরে তাদের মধ্যে আরও দুজন এই ঘটনার স্বাক্ষী আছে, একজন সমীর মন্ডল আর অন্যজন আমিন হোসেন। ভেটকোল আরও জানায় যে সেই এই দুজনের কাছে অনুরোধ করে ব্যাপার টা পাঁচ কান না করার জন্য। কারন তাহলে সবাই ভেটকোলের ভ্যান ছেড়ে টোটোতে চেপে বাড়ি ফিরবে কারন টোটো তে আলোর ব্যবস্থা থাকলেও ভেটকোলের ভ্যান ছিল লাইট বিহীন। শুধুমাত্র রাতের বেলায় ভাড়া কম বলেই অনেকে তার ভ্যানে সওয়ার হতো। কিন্তু লাইট বিহীন ভ্যানে মেতে মেতে যদি এরকম ঘটনার স্বাক্ষী হতে হয় তবে তার ভ্যানে আর কেউ চড়বে না। সব শুনে অলোক হুমকি দেয় ভেককোল কে যে যদি না সে এইসব কথা প্রহ্লাদের বাবার সামনে স্বীকার করে তবে এই পুরো ঘটনা সে পঞ্চায়েতে জানাবে। ভয় পেয়ে ভেটকোল শেষে রাজি হলো তবে যাতে ব্যাপার খানা গোপন থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখার অনুরোধ করলো। ভেটকোলের সাথে আলোকের পুনরায় এভাবে আগমনে প্রহ্লাদের বাবা চটে গিয়ে তাদের বাড়ি থেকে বের করতে উদ্যত হলে প্রহ্লাদের মা শান্তিময়ী দেবী এসে স্বামীকে বাধা দিলেন। আসলে তিনি সকালেই দরজার আড়াল থেকে সব কথা শুনেছিলেন আর তাই ছেলের এহেন ঘটনায় চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অলোক ও ভেটকোল কে বসতে বসে স্বামীকে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে এসে বললেন যে তার স্বামীর এরূপ রুঢ় ব্যবহারে তিনি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত এবং ভেটকোলকে অনুরোধ করলেন যে তিনি,তার স্বামী এবং অলোক বাবুকে ঝোড়ো তান্ত্রিকের বাড়িতে রাতে পৌঁছে দেয় সে। ঝোড়ো তান্ত্রিকের বাড়িতে যখন প্রবেশ করলো সবাই বিকেল প্রায় চারটে। দুই ক্রোশ দূরে এক গ্রামে ঝাড়িয়ে ফিরেছে সবে সে। মুখ হাত ধুয়ে উঠোনের মোড়াতে বসে যখন বিড়ি টানছিল ঝোড়ো সামনে এসে উপস্থিত হলো সবাই। পুরো ঘটনার বৃত্তান্ত শুনে ঝোড়ো বলে উঠলো তাহলে এর আগে পুলিশে মাঠে ব্যর্থ হয়ে যে তিনটে ছেলে আত্মহত্যা করে তারা কি এই পিশাচের স্বীকার। ভ্রু কুঁচকে উঠে ঘরে দৌড়ে চলে যায় ঝোড়ো। পাঁচ মিনিট পরে পাঁজি হাতে বেরিয়ে এসে অত্যন্ত ভয়ার্ত কন্ঠে বলে আজ রাতেই এর বিহিত করতে হবে। ভৌম্য আমাবস্যার রাতে এর আগে বিগত পাঁচ বছরে এই গ্ৰাম আর পাশের গ্ৰামে মোট তিনজন এরকম ছেলের আত্মহত্যা ঘটে যারা বারবার সেনাবাহিনী ও পুলিশের পরীক্ষায় মাঠে ব্যর্থ হয়েছে।